নিজস্ব প্রতিবেদক : মুঘল সাম্রারাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাদশা বাবর রচিত বাবরনামা একটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক গ্রন্থ। গ্রন্থের দশ পর্বের ছিয়ানব্বই অধ্যায়ের নানা চিত্তাকর্ষক বর্ণনা পাঠকদের আকর্ষণ করে। তেমনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের ‘জাহাঙ্গীরনামা’ ও সম্রাট আকবরের ‘আকবরনামা’ নানা রোমাঞ্চকর বর্নণায় ভরপুর। আমাদের আশপাশের অনেকই ঐ বাবরনামা, জাহাঙ্গীরনামা বা আকবরনামার মতো বিখ্যাত হতে চান। তবে ভালো কাজের ধারের কাছে না গিয়ে নানা অনিয়ম, মোসাহেবী ও ধান্ধাবাজি করে ভাগ্য গড়েন তারা। এমনি একজন টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার নন্দনপুরের বাসিন্দা জিল্লুর রহমান শিহাব। আদি নিবাস নোয়াখালি। ডাক নাম শিহাব। তাকে নিয়েই আজকের মহাকাব্যের প্রথম পর্ব ‘শিহাবনামা (১)’। পাঠকদের জন্য বাবরনামার অনুকরণে শিহাবনামাকে কয়েকটি পর্বে বিভক্ত করে ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করা হবে।
জিল্লুর রহমান শিহাব। বি কম পাশ। পরে সার্টিফিকেট বিক্রিতে সিদ্ধহস্ত একটি অখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতোকত্তোর ডিগ্রী অর্জনের দাবি করেন। পেশায় নিন্মমাধ্যমিক বেসরকারি স্কুল শিক্ষক। উপজেলার পৌরসভাস্থ হাটবৈরাণ নিন্মমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হলেও তিনি অধ্যক্ষ বলে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। ভিজিটিং কার্ড, সামাজিক বা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানেও নিজেকে অধ্যক্ষ পরিচয় দিয়ে থাকেন। লোকে হাসাহাসি করলেও তিনি তা গায়ে মাখেন না। যত তারা আকাশে জল জল করে, তার চেয়েও বেশি স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের অভিযোগ চক চক করছে তার বিরুদ্ধে। গোপালপুর বার্তাসহ স্থানীয় মিডিয়াকর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টায় হাজারো অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে।
তবে এসব অভিযোগ থোড়াই কেয়ার করেন তিনি। বলে বেড়ান, ‘তিনি এমপির লোক।’ একদিকে অধ্যক্ষ পদের তকমা, অন্যদিকে সাংসদ খন্দকার আসাদুজ্জামানের খাস লোক। এ দুই রাশভারী পরিচয়ে তিনি কোটি থেকে কোটিপতি। চলনে-বলনে গদাইলস্করী, আস্ফালনে গগন চুম্বি, দাম্বিকতায় সেরা, টাকার গরমে অন্ধ, আর মানি লোকের সম্মানহানিতে পটু। তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, শিক্ষা ক্ষেত্রে দুরন্তপনা, পরীক্ষা হলে নকল আমদানী আর নিন্মমানের পাঠ্যপুস্তক পাঠ্য তালিকাভূক্ত করে প্রকাশনা সংস্থা থেকে উৎকোচ আদায়।
গোপালপুরের শিক্ষাঙ্গনে মশহুর যে কারণে তা হলো, পরীক্ষা হলে নকল চালুর পুরোহিত তিনি। তার পৌরহিত্যেই শিল্পসম্মত রূপ পেয়েছে নকল। হোক সে জেএসসি, এসএসসি বা এইচএসসি। নামে কিইবা আসে যায়। সর্বত্রই ধুন্ধুমার নকল করার প্রকাশ্য সুযোগ। ঢাল একটাই। তাহলো সাংসদের নাম ভাঙ্গানো। তার বিরুদ্ধে গোপালপুরে পরীক্ষা হলে অবাধে নকল আমদানীর অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষা সংক্রান্ত এক আলোচনা সভায় আলমনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মোমেন গোপালপুরে নকল আমদানীর ক্ষেত্রে আঙ্গুল তোলেন শিহাবের দিকে। উপজেলা চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার দিলরুবা শারমীন, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ, পৌর মেয়র রকিবুল হক ছানাসহ সরকারি দলের নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, জিল্লুর রহমান শিহাবের কর্মস্থল আসাদুজ্জামান একাডেমি একটি নিন্মমাধ্যমিক বিদ্যালয়। স্কুলে এমপিও ভূক্ত শিক্ষক মাত্র এগারোজন। অবশিষ্টরা ননএমপিও স্টাফ। প্রধান শিক্ষক শিহাব পনেরো হাজার টাকা স্কেলে বেতনভাতা পান। নিন্মমাধ্যমিক হওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবছর এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করান অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। দুই বছর আগে কারিগরী শাখায় এইচএসসি খোলেন। পাঠদানের অনুমতি পেলেও এইচএসসিতে এমপিওধারি প্রভাষক নেই একজনও। তাতে কী? প্রভাষক থাক বা না থাক তিনি অধ্যক্ষ। এমপিও স্ট্যাটাসে জুনিয়র হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। দাবি অধ্যক্ষ। ভাইসচ্যান্সেলর দাবিতেও কারো আপত্তি নেই। কারণ তিনি এমপির লোক। এমন ভয়ভীতি দেখিয়েই স্কুলের কয়েক সহকর্মীকে কোনঠাসা করেছেন, সুবিধা লুটছেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি গোপালপুর উপজেলা শাখাকে বিভক্ত করে। নকল চালুর অবৈধ বানিজ্য করছেন ঐতিহ্যবাহী সূতি ভিএম পাইলট মডেল হাইস্কুল পরীক্ষা কেন্দ্রকে বিভক্ত করে নিজ প্রতিষ্ঠানকে ভেন্যু বানিয়ে।
জিল্লুর রহমান শিহাব ২০১৩ সালে চার প্রধান শিক্ষকের দস্তখত জাল করে আসাদুজ্জামান একাডেমিতে এসএসসি পরীক্ষার ভেন্যু করার অনুমতি আনেন ঢাকা বোর্ড থেকে। আর এ নিন্মমাধ্যমিক বিদ্যালয়টি যেহেতু স্থানীয় সাংসদ খন্দকার আসাদুজ্জামানের নামে, সেহেতু ওই ভদ্র লোককে ভুল বুঝিয়ে তার সুপারিশ নিয়ে, ভূয়া তথ্যে ঢাকা বোর্ডকে মিসগাইড করে ভেন্যু মঞ্জুর করেন। জেএসসির পর এসএসসি এবং এসএসসির পর এইচএসসি পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করছেন এভাবে।
চলিত (২০১৮) এসএসসি পরীক্ষায় আসাদুজ্জামান একাডেমির ভেন্যু হয়েছে হাটবৈরাণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। অর্ধশতাব্দী প্রাচীন ওই বিদ্যালয় ভবনের ছাদে, দেয়ালে, ভীমে অসংখ্য ফাটল। আস্তরন খসে পড়ছে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটি যে কোনো সময় ধ্বসে পড়তে পারে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরীক্ষার্থীরা এখানে পরীক্ষা দিতে বাধ্য হচ্ছে। এখানে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা দিতে পাঠিয়ে বাবামারা থাকেন আতঙ্কে। না জানি কখন ভবন ধ্বসে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু লোভের কাছে হার মানছে জীবনের ঝুঁকি। ভবনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জানালা না থাকায় ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকে। কেন্দ্রের মাত্র পাঁচ গজ দূরে বাসাবাড়িতে বিদ্যুতের আলো জলছে। কিন্তু স্কুলে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। পরীক্ষার্থীরা অন্ধকারে পরীক্ষা দিতে বাধ্য হচ্ছে। কেন্দ্রে দায়িত্বরত সরকারি কর্মকর্তা উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার ও পশু চিকিৎসক জানান, পরীক্ষার্থীদের দুরাবস্থার কথা ভেবে কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান শিহাবকে অস্থায়ীভাবে হলেও বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা বলেন। কিন্তু তিনি তা কানে তোলেন নি।
আসাদুজ্জামান একাডেমির কয়েক পরীক্ষার্থী ও তার অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, গণিত, ইংরেজিসহ চার বিষয়ে পরীক্ষা হলে বিশেষ সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ভালো রেজাল্ট করিয়ে দেয়ার নামে শিক্ষার্থী পিছু দুই হাজার করে ডোনেশন ধার্য করা হয়। প্রত্যেক বছর এ ধরনের ডোনেশনের টাকা তুলে এর একটি অংশ দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের পকেটস্থ করেন। যাতে পরীক্ষার হলে নকল করার সুযোগ পাওয়া যায়।
পরীক্ষা হলে অসদুপায় অবলম্বনের কাজে সহযোগিতা করেন জিল্লুর রহমান শিহাবের দুস্কর্মের সঙ্গী শিক্ষক সবুজ। পরীক্ষার দিন প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর নিকট থেকে বিদায় অনুষ্ঠানের নামে এবারো পাঁচশো টাকা করে বাধ্যতামূলকভাবে চাঁদা আদায় করা হয়েছে। এ স্কুলের কারিগরি সেকশনে ভর্তি হওয়া বিশেষ করে ইন্টারমিডিয়েট সেকশনের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই ক্লাস করেনা। প্রতিষ্ঠানের ইন্টারের বিভিন্ন ট্রেড কোর্সের জন্য নূণ্যতম শিক্ষক, শিক্ষা সরঞ্জাম, বইপুস্তক, কারিগরী সরঞ্জাম, প্রায়োগিক বা শিক্ষামূলক উপযুক্ত ক্ষেত্র নেই। প্রতি বছর গোপালপুরের বাইরে থেকে শিক্ষার্থীদের এখানে হায়ার করে আনা হয়। নকল করে পরীক্ষা দেয়ার নিশ্চয়তা দেয়া হয়। তারপর বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়ে ফরমফিলাপ করান কথিত অধ্যক্ষ জিল্লুর রহমান শিহাব। আর এভাবেই নকল করিয়ে শতভাগ অথবা তার চেয়ে কিছু কম পাশ করনোর ক্রেডিট দেখিয়ে চলছেন বছরের পর বছর। শতভাগ পাশের বাহাদুরি দেখিয়ে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ হবার চেষ্টা চালাচ্ছেন জিল্লুর রহমান শিহাব। এবারো ভরসা স্থানীয় সাংসদের সুপারিশ। বয়সের ভারে ন্যুজ হওয়ায় সাংসদকে বিভ্রান্ত করেন কৌশলে।
জিল্লুর রহমান শিহাব অবশ্য এসব অভিযোগ সব সময় অস্বীকার করে আসছেন। তিনি সরকারি দলের নেতা। তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে নিন্দুকেরা তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন।